নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর অপেক্ষায় ১০ বছর পার
রাজধানীর বনানী থেকে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে গাড়িচালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন সাবেক সংসদ সদস্য এম ইলিয়াস আলী। সেই থেকে বিএনপির সাবেক এ সাংগঠনিক সম্পাদকের ব্যাংক হিসাব জ’ব্দ হয়ে আছে। পরিবারের আশা- ইলিয়াস আলী ফিরবেন এবং জ’ব্দ হয়ে থাকা ব্যাংক হিসাব তিনি নিজেই চালু করবেন।এদিকে তার সন্ধান দাবিতে সিলেট মহানগর, জে’লা এবং তার নির্বাচনী এলাকা ওসমানীনগর ও বিশ্বনাথ উপজে’লায় চার দিনের কর্মসূচি নিয়েছে বিএনপি।
জানা গেছে, গু’ম ব্যক্তিদের ব্যাংক থেকে টাকা পয়সা তোলা, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বণ্টনে সমস্যা থাকে। তবে আ’দালত বিশেষ বিবেচনায় পরিবারগুলোকে জমানো টাকার কিছু অংশ তোলার অনুমতি দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো, পরিবারগুলো আশায় থাকে- গু’ম হওয়া স্বজন ফিরে আসবেন। তাই অনেক সময় আ’দালতে যান না তারা। ইলিয়াস পরিবারও সেই আশাতে আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইলিয়াস আলীর সহধ’র্মিণী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা তাহসিনা রুশদির লুনা বলেন, ‘আমা’র স্বামীর নামে থাকা ব্যাংক হিসাব সেই থেকে (২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল) জ’ব্দ হয়ে আছে। একদিন হয়তো প্রিয় মানুষটি পরিবারের কাছে ফিরে আসবেন।’
এদিকে নিখোঁজের পর স্বামী ইলিয়াস আলীর সন্ধান পেতে সন্তানদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন তাহসিনা রুশদির লুনা। স্বামীর সন্ধানে উচ্চ আ’দালতেরও দ্বারস্থ হন। যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন দপ্তরেও। কিন্তু সব জায়গা থেকেই আসে হতাশার খবর। ইলিয়াস আলীকে বহন করা গাড়িটি রাজধানীর মহাখালীতে পাওয়া গেলেও ১০ বছরেও ইলিয়াস আলী ও আনসার আলী আর ফিরে আসেননি।
স্বামী ইলিয়াস আলীর সঙ্গে শেষ স্মৃ’তি তুলে ধরে লুনা বলেন, ‘২০১২ সালের ১৪ এপ্রিল ছিল পহেলা বৈশাখ। ওইদিন তিনি নির্বাচনী এলাকা সিলেটের বিশ্বনাথে গিয়েছিলেন। ১৭ এপ্রিল দুপুরে তিনি বনানীর বাসায় ফিরেন। অফিস (তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মক’র্তা ছিলেন) থেকে বাসায় ফিরে দেখি, তিনি ঘুমাচ্ছেন। দীর্ঘপথ জার্নি করে ক্লান্ত। তাই তাকে আর ডাকিনি। সন্ধ্যায় বাচ্চাকে নিয়ে আমি মিরপুরে ডাক্তার দেখাতে যাব, তখন তিনি বলেন- আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। কিন্তু আমি তাকে নিতে চাইনি। ২০ বছরের দাম্পত্য জীবনের সেটাই ছিল আমাদের শেষ কথা।’
তিনি আরও বলেন, ‘সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে দেখি, তিনি (ইলিয়াস) বাসার নিচতলার বৈঠকখানায় দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে গল্প করছেন। তখন আর কথা বলিনি। রাত ৮টার দিকে নিচতলা থেকেই তিনি বের হয়ে যান। কোথাও বের হলে সব সময় আমাকে বলে যেতেন। কিন্তু বাসায় লিফট না থাকায় সেদিন আর তিনি ওপরে ওঠেননি। পরদিন সকালে অফিস থাকায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে আমি ঘুমিয়ে পড়ি।’
ইলিয়াস আলীর বড় ছে’লে আবরার ইলিয়াস অর্ণব লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে দেশেই একজন সিনিয়র আইনজীবীর অধীনে প্র্যাকটিস করছেন। ছোট ছে’লে সায়ার লাবিব গত বছর উচ্চশিক্ষার জন্য যু’ক্তরাজ্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। একমাত্র মে’য়ে সায়ারা নাওয়াল সম্প্রতি এসএসসি পাস করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে।
গ্রামের বাড়ি বিশ্বনাথের রামধানায় থাকেন ইলিয়াসের বৃদ্ধ মা সূর্যবান বিবি। রুগ্ন-ভগ্ন শরীর, ছে’লের শোকে চোখের নিচে কালি জমেছে সেই কবে। এখন যেন কাঁদতেই ভুলে গেছেন। আগের মতো সবার সঙ্গে কথাও বলেন না। কেউ কথা বলতে চাইলে রাজ্যের বির’ক্তি প্রকাশ পায় চেহারায়। তবে অনেক চেষ্টার পর তার সঙ্গে কথা হয়।
শুরুতেই হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করে সূর্যবান বিবি বললেন, ‘আমা’র আর পাগলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমা’র সঙ্গেকথা বলে কোনো লাভ নেই। সবার উপরেই আমা’র ক্ষোভ। ছে’লেকে ফিরে পাবার আশায় অনেক বলেছি, অনেক কেঁদেছি। অনেকের কাছে আকুতি করেছি। সবাই শুধু মি’থ্যে সান্তনাই দিয়েছে। কেউই আমা’র ছে’লের সন্ধান দিতে পারেনি। তাকে আমা’র কাছে ফিরিয়ে দিতে পারেনি। প্রিয় সন্তানের জন্য আল্লাহর নিকট চাওয়া ছাড়া কাউকে আর কিছু বলি না। দয়াময়ের কাছে ফরিয়াদ করি রোজ। তিনি তো কাউকে নিরাশ করেন না।’
সূর্যবান বিবি তাই এখনো বিশ্বা’স করেন- আজ হোক কিংবা কাল, তার প্রিয় ইলিয়াস মায়ের কোলে ফিরবে।